এখন থেকে বছরে ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হয়- এমন করদাতার আয়কর রিটার্ন নিয়মিত খতিয়ে দেখবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। এনবিআরের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে এ বিধান কার্যকর করা হবে। কারও রিটার্নে বড় অঙ্কের ব্যাংক হিসাব গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেলে হিসাব জব্দ ও মামলা করা হবে। এনবিআরের প্রণীত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আয়কর রিটার্নে ব্যাংক লেনদেনের সব তথ্য দেখানো হয়েছে কি না, তা যাচাই করা হবে। বিশেষভাবে ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে যে পরিমাণ আয়-ব্যয় করা হয়েছে ও সম্পদ কেনাবেচা হয়েছে, তার প্রকৃত তথ্য রিটার্নে উল্লেখ করা হয়েছে কি না, তা কঠোরভাবে যাচাই করা হবে। বিভিন্ন সময়ে এনবিআরের তদন্তে দেখা গেছে যে কর ফাঁকি দিতে করদাতারা ব্যাংকিং লেনেদেনের তথ্য গোপন করে থাকেন। এক বছরের লেনদেনের তথ্য প্রতিবছরের জানুয়ারিতে সংগ্রহ করা হবে। এসব তথ্য আয়কর রিটার্নের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক করদাতা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করেন। এসব ব্যবসার আয়-ব্যয় ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে হিসাব খুলে পরিচালনা করেন। কর ফাঁকি দিতে অনেকে ব্যবসার তথ্য গোপন করে আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করেন না। এসব ক্ষেত্রে ওই সব ব্যবসার লেনদেন যে ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালনা করেন, তার তথ্য আয়কর রিটার্নে গোপন রাখেন।
অনেকে বিভিন্ন ব্যাংকে মোটা অঙ্কের অর্থ সঞ্চয় হিসাবে গচ্ছিত রাখেন। অনেকে উত্তাধিকার সূত্রে বড় অঙ্কের অর্থের মালিক হন। তারা এসব অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করলেও তার তথ্য আয়কর ফাইলে উল্লেখ করেন না। মূলত কর ফাঁকি দিতেই এ কাজ করে থাকেন।
অনেক করদাতার সন্তান বিদেশে পড়তে যান। এ ক্ষেত্রে স্টুডেন্ট (শিক্ষার্থী) ফাইল খুলে বিদেশে টিউশন ফি পাঠিয়ে থাকেন। স্টুডেন্ট ফাইলে অর্থ পাঠাতে হলে করদাতাকে প্রথমে নিজের ব্যাংক হিসাবে জমা দিতে হবে। এরপর জমা দেওয়া অর্থ স্টুডেন্ট ফাইলের মাধ্যমে বিদেশে তার সন্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা দিয়ে থাকেন। অনেক করদাতা এসব হিসাবের তথ্য আয়কর ফাইলে উল্লেখই করেন না।
অনেক করদাতা কোটি টাকা দামের একাধিক গাড়ির মালিক হলেও সব গাড়ির তথ্য রিটার্নে উল্লেখ করেন না। অনেকে বিলাসবহুল একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিক হলেও তার তথ্যও রিটার্নে উল্লেখ করেন না। অথচ এসব গাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লট ব্যাংকের মাধ্যমে কেনা হয়।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, অনেকে রিটার্নে তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এটা চলতে পারে না। ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করেই আয়-ব্যয় ও সম্পদ করছে। ব্যাংকের মাধ্যমে কে কত লেনদেন করছে, তার প্রকৃত তথ্য আয়কর রিটার্ন উল্লেখ থাকতে হবে। লেনদেনের ওপর নির্ভর করে প্রকৃত করের পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব। ব্যাংকের প্রকৃত লেনদেন আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করতে হবে। রিটার্নে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হলে এনবিআর কঠোর হবে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন থাকলেও অনেকে রিটার্নে তা উল্লেখ করেন না। ব্যাংকে কে কত লেনদেন করছেন বা গচ্ছিত রাখছেন, তা খুঁজে বের করা সম্ভব হলে কর ফাঁকি দেওয়া বন্ধ হবে।
তিনি আরও বলেন, রিটার্নের তথ্য খতিয়ে দেখে সারা দেশের কোটিপতির সংখ্যা পাওয়া যায়। ব্যাংকের লেনদেন খতিয়ে দেখে দেশের কোটিপতির যে সংখ্যা পাওয়া যায়, রিটার্নের সংখ্যার সঙ্গে তা মেলে না। ব্যাংকের তথ্যে কোটিপতির সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি থাকে। রিটার্নে মিথ্যা দেওয়ার কারণে এমনটা হয়। এনবিআর ব্যাংক হিসাবে নজরদারি বাড়ালে কর ফাঁকির পরিমাণ কমবে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি বছরের মার্চ শেষে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২টি। দেশে কোটিপতির সংখ্যা এক লাখের বেশি হলেও রিটার্নে জমা দেওয়া তথ্যানুসারে কোটিপতির সংখ্যা গত পাঁচ বছর ধরে গড়ে ২৫ হাজারেই আটকে আছে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্যানুসারে, কোটি টাকার গাড়ির মালিক ৬০ হাজারের বেশি। অন্যদিকে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তথ্যানুসারে কোটি টাকার ফ্ল্যাটের মালিক এক লাখের বেশি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, অসৎ করদাতারা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্যই রিটার্নে মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকেন। গাড়ি, বাড়িসহ বড় ধরনের লেনদেন সব ব্যাংকের মাধ্যমেই হয়। ব্যাংকের তথ্য জোগাড় করে এনবিআর খতিয়ে দেখতে সক্ষম হলে কর ফাঁকি কমে যাবে। তবে লক্ষ রাখতে হবে বছরে ১০ লাখ টাকা আয় খুব বড় ধরনের আয় না। এতে যেন সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার না হন। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআর দুই প্রতিষ্ঠান- একে অন্যের তথ্য অনলাইনে মিলিয়ে দেখার সুযোগ পেলে করদাতাদের মিথ্যা তথ্য দেওয়ার সুযোগ কমবে।।