ঢাকা | বঙ্গাব্দ

প্রস্তাবিত জুলাই সনদে নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের পৃথকীকরণ বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে

  • আপলোড তারিখঃ 16-10-2025 ইং
প্রস্তাবিত জুলাই সনদে নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের পৃথকীকরণ বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে ছবির ক্যাপশন: সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় একীভূত নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে এক অনন্য ঐতিহ্যের ধারক বহন করছে। শতাব্দীপ্রাচীন এ ব্যবস্থার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে দেশের আর্থিক জবাবদিহি ও সুশাসনের অন্যতম স্তম্ভ বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (CAG)-এর কার্যালয়। সম্প্রতি জুলাই সনদ-২০২৫-এ প্রস্তাবিত নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের পৃথকীকরণ বিষয়টি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রণীত এ সনদটি যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, দক্ষতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্য ধারণ করে, সেখানে ওই প্রস্তাবটি একটি পরীক্ষিত ও কার্যকর ব্যবস্থাকে দুর্বল করার আশঙ্কা তৈরি করছে।



নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের ইতিহাস উপমহাদেশে ১৮৬০ সালের দিকে গঠিত ‘ইন্ডিয়ান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিস’ (IA&AS) পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটিশ প্রশাসন আর্থিক শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি বজায় রাখতে যে একীভূত কাঠামো প্রবর্তন করেছিল, সেটিই আজকের বাংলাদেশের নিরীক্ষা ও হিসাবব্যবস্থার ভিত্তি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ১২৭-১৩২) সিএজির দায়িত্ব ও ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে সংরক্ষণ করে যাতে প্রি-অডিটসহ সার্বিক আর্থিক নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকে। এ একীভূত কাঠামোর মাধ্যমে হিসাব বিভাগ সরকারি ব্যয় অনুমোদনের আগেই প্রি-অডিট পরিচালনা করে। এটি একদিকে অনিয়ম প্রতিরোধ করে, অন্যদিকে প্রশাসনিক অপচয় ও দুর্নীতির পথ রোধ করে। অর্থাৎ, এটি একটি কার্যকর ‘ইন-বিল্ট চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ ব্যবস্থা, যা সুশাসনের মূল ভিত্তি


দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন, ’৭২-এর সংবিধান আমাদের শাসনের ভিত্তি। এটা আশার কথা এজন্য যে, তারা ওই শাসনতন্ত্রের মূল স্পিরিটের পরিপন্থি কোনো আইন করবেন না বা চলমান কিছুও পরিবর্তন করবেন না। জুলাই সনদের ৭৯ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগকে পৃথক করার চিন্তা মূলত প্রশাসনিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির যুক্তিতে উপস্থাপিত হয়েছে। বাস্তবতা হলো- এ পৃথকীকরণ কার্যকর হলে আর্থিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


প্রথমত, হিসাব বিভাগ যদি প্রশাসনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন হয়, তাহলে প্রি-অডিট কার্যক্রমের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারি কর্মকর্তারা তাদের নিজেদের ব্যয় অনুমোদনের জন্য একই প্রশাসনিক কাঠামোর অধীন হিসাব কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব খাটাতে পারবেন। এতে নিরীক্ষার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে এবং দুর্নীতির সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়বে। দ্বিতীয়ত, এ প্রস্তাব কার্যকর হলে রাষ্ট্রীয় আর্থিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান ভারসাম্য ভেঙে পড়বে। বর্তমান কাঠামোয় CAG কার্যালয় এবং হিসাব কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি পেশাগত ভারসাম্য আছে, যেখানে একজন নিরীক্ষক হিসেবে দক্ষ হতে হলে তাকে হিসাবব্যবস্থায় অভিজ্ঞ হতে হয় এবং একজন হিসাবরক্ষকও নিরীক্ষার নীতিমালা সম্পর্কে সচেতন থাকেন। পৃথকীকরণের ফলে এ পেশাগত মেলবন্ধন ভেঙে যাবে, যা কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও জবাবদিহি উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।


তৃতীয়ত, প্রশাসনিক ব্যয়ের ওপরও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। পৃথক কাঠামো মানে নতুন প্রশাসনিক প্রধান, ভবন, বাজেট, প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামোগত পুনর্বিন্যাস যা রাষ্ট্রীয় অর্থের ওপর অপ্রয়োজনীয় বোঝা সৃষ্টি করবে। এর ফলে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু কার্যকারিতা বাড়বে না।


ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। ভারত ১৯৭০-এর দশকে নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের আংশিক পৃথকীকরণ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছিল, কিন্তু বাস্তব ফল সন্তোষজনক না হওয়ায় পরে আবার একীভূত কাঠামোয় ফিরে আসে। কারণ দেখা গেছে, পৃথকীকরণের ফলে নিরীক্ষা রিপোর্ট সময়মতো প্রকাশ পেত না, সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা কমে যায় এবং প্রি-অডিট প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক অডিট সংস্থা INTOSAI-এর Lima Declaration of Guidelines on Auditing Precepts (1977) এবং Mexico Declaration (2007) উভয়েই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, অডিট সংস্থার স্বাধীনতা এবং আর্থিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর একীভূত রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির মূল উপাদান। অর্থাৎ, যেসব দেশে হিসাব ও নিরীক্ষা একীভূত, সেখানে সুশাসনের সূচক (Governance Index) সাধারণত বেশি।


বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৭ থেকে ১৩২ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত সিএজির দায়িত্ব, ক্ষমতা ও স্বাধীনতা নির্ধারিত হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রের সব হিসাবের নিরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের ওপর ন্যস্ত।’ অর্থাৎ, হিসাব বিভাগকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়া মানে এ সাংবিধানিক ভারসাম্য নষ্ট করা। এমন একটি সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে আদালতীয় বিতর্ক ও সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।


প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতীক: প্রি-অডিট শুধু হিসাব যাচাই নয়; এটি একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যা রাষ্ট্রীয় তহবিলের সঠিক ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করে। এ ব্যবস্থায় ব্যয় হওয়ার আগেই তার বৈধতা, যৌক্তিকতা ও বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য যাচাই করা হয়। প্রি-অডিট কার্যকর না থাকলে আর্থিক অনিয়মের প্রবণতা বহুগুণে বাড়ে। বাস্তব উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, গণপূর্ত বা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মতো কিছু ক্ষেত্রে যেখানে প্রি-অডিট দুর্বল, সেখানে ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বারবার।


প্রি-অডিট (preventive control) এবং পোস্ট-অডিট (detective control) একত্রে থাকলে আর্থিক শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। প্রি-অডিট ব্যয় হওয়ার আগে অনিয়ম প্রতিরোধ করে, আর পোস্ট-অডিট ব্যয় হওয়ার পরে বিশ্লেষণ করে কোথায় উন্নতির সুযোগ আছে বা কোন খাতে বিচ্যুতি ঘটেছে তা শনাক্ত করে। এ দুই ব্যবস্থার সমন্বিত প্রয়োগ একটি একীভূত নিরীক্ষা ও হিসাব কাঠামো তৈরি করে, যা রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে।


যেহেতু বাংলাদেশে সিএজি কার্যালয় জাতিসংঘ স্বীকৃত Supreme Audit Institution (SAI) হিসেবে কাজ করছে, তাই প্রি-অডিট ও পোস্ট-অডিট- উভয় কার্যক্রমের নেতৃত্ব এ কার্যালয়ের অধীনে থাকা সর্বাধিক যৌক্তিক। এটি প্রশাসনিক জটিলতা কমায়, অডিট মানদণ্ডে একরূপতা আনে এবং নীতিগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। উন্নত দেশগুলো যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত বা কাতারে তাদের অডিট প্রতিষ্ঠানকে ‘কোর্ট অব অডিট’ মর্যাদা দিয়েছে, যেখানে আর্থিক অনিয়ম শনাক্তের পাশাপাশি শৃঙ্খলামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতাও থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সিএজি কার্যালয়ের অধীনে একীভূত প্রি ও পোস্ট অডিট কাঠামো গঠন করা গেলে রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থায় জবাবদিহি, সুশাসন ও দুর্নীতিবিরোধী প্রতিরোধ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।


ভাঙন নয় বরং শক্তিশালীকরণ: জুলাই সনদের মূল লক্ষ্য যদি হয় সুশাসন ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, তবে পৃথকীকরণের পরিবর্তে বিদ্যমান কাঠামোকে শক্তিশালী করাই হবে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ। প্রথমত, মানবসম্পদ উন্নয়ন: হিসাব ও নিরীক্ষা কর্মকর্তাদের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল টুলস ব্যবহারের দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক অডিট মানদণ্ডে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিনির্ভরতা বৃদ্ধি: ডিজিটাল অডিট, ডাটা অ্যানালিটিকস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনিয়ম শনাক্তের গতি বাড়ানো সম্ভব। তৃতীয়ত, প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন: সিএজি কার্যালয়ের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে যেমন আছে, বাস্তব প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় তা আরও শক্তিশালী করতে হবে। চতুর্থত, আইনি কাঠামো হালনাগাদ: নিরীক্ষা সংক্রান্ত আইনগুলো (যেমন: CAG’s (Duties, Powers and Conditions of Service) Act) যুগোপযোগী করা প্রয়োজন, যাতে প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।


রাষ্ট্রীয় আর্থিক ব্যবস্থার মতো সংবেদনশীল একটি বিষয়ের সংস্কারে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, সংসদীয় কমিটি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়াই হবে পরিপক্ব পদক্ষেপ। বাংলাদেশ বর্তমানে স্মার্ট প্রশাসনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এ অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। বারবার কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে নয়, বরং বিদ্যমান কাঠামোকে শক্তিশালী করেই রাষ্ট্রীয় জবাবদিহি ও সুশাসনের কাঠামোকে দৃঢ় করা সম্ভব। সুশাসনের ভিত্তি হলো স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহি। আর এ তিনের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে একটি কার্যকর নিরীক্ষা ও হিসাবব্যবস্থা। জুলাই সনদ-২০২৫-এর প্রস্তাব নম্বর ৭৯-এ ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করার আশঙ্কা তৈরি করছে। তাই এ প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনা করা সময়ের দাবি। সংস্কার মানে ভাঙন নয়, সংস্কার মানে উন্নয়ন, পরিশীলন ও শক্তিশালীকরণ। নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের একীভূত কাঠামো সংরক্ষণ করে তাকে যুগোপযোগী রূপে উন্নীত করাই হবে একটি দূরদর্শী, রাষ্ট্রনির্ভর ও সুশাসনমুখী সিদ্ধান্ত। তাহলে জুলাই সনদেও এমন কিছুতে তারা নীতিগতভাবে সম্মত হবেন না, যা ওই মূলনীতির সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের কাজের অতি ভিড়ে এখনই এর অন্তভুর্ক্ত সবকিছু বিশ্লেষণ করে তাদের পক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি। ফলে কোনো কোনো বিষয় সাধারণভাবে তারা সম্মত হয়ে থাকতে পারেন। নির্বাচনে গিয়ে ওই সনদভিত্তিক আইন প্রণয়নের সময় তারা যাতে শাসনতন্ত্রের মূলনীতির পথে থাকেন, সে বিযয়ে সাহায্য করার জন্যই এ নিবন্ধ লেখা। কারণ যেকোনো সিভিল সার্ভিসের সদস্য তার সার্ভিসের প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য কাজেই সঠিক পরামর্শ দিয়ে রাজনীতিবিদদের সহায়তা করা তাদের কর্তব্য। জাতীয় নীতিনির্ধারক মহলের প্রতি আহ্বান- রাষ্ট্রীয় আর্থিক ব্যবস্থার এ ঐতিহ্যবাহী ও কার্যকর কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে আধুনিকীকরণের পথে অগ্রসর হোন। তবেই টেকসই সুশাসন ও প্রকৃত জবাবদিহিমূলক বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।


লেখক: সরকারের প্রাক্তন সিনিয়র সচিব ও প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল


নিউজটি পোস্ট করেছেনঃ focusullapara

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
notebook

প্রস্তাবিত জুলাই সনদে নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের পৃথকীকরণ বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে