জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই লিখেছেন, ‘যতীন সরকার নানা কারণে আমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় তার নিষ্ঠা সুবিদিত। আদর্শবাদের প্রতি পক্ষপাতে তিনি দুষ্ট নন। তার সর্ববিধ বিচারে জীবনের প্রতি গভীর আসক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তত্ত্বের সঙ্গে জীবনানন্দের এ যোগ তার কাছ থেকে আমাদের বড় পাওয়া।
যতীন সরকার (১৯৩৬-২০২৫) একজন সত্যিকারের শিক্ষাবিদ, মননশীল প্রাবন্ধিক, মানবতাবাদী লেখক, বিশিষ্ট বৈয়াকরণিক, শ্রমনিষ্ঠ গবেষক, বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক, পান্থজনের নির্মল বন্ধু, নির্ভেজাল এবং খাঁটি দেশপ্রেমিক সজ্জন ছিলেন। তাকে হারিয়ে আমরা আধুনিককালের একজন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও মুক্তচিন্তককে হারালাম। কারণ তিনি বহুগুণের অধিকারী একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার তার দুর্মর সাহস ছিল। তিনি ছিলেন বহু শ্রুতশীল নিমগ্ন পাঠক, যুক্তিবাদী তার্কিক এবং অনর্গল মিষ্টভাষী বক্তা। মার্কসবাদে দীক্ষা নিলেও তিনি কোনোদিন দলকানা ছিলেন না। শ্রেণিকক্ষে, সভা-সমাবেশে এবং লেখনীতে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এমন বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ ও নির্ভীকতায় তার আগে কেউ কোনোদিন তুলে ধরেনি।
যতীন সরকার নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামে এক হতদরিদ্র পরিবারে ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকার ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। তিনি ছিলেন তার পিতামহের একমাত্র সন্তান। তার আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয় রামপুর ফ্রি বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। দেশ বিভাগের পর তাদের প্রতিবেশী তিন গ্রামের প্রায় সবাই ভারতে চলে যায়। ফলে তার বাবার ডাক্তারি পেশা থেকে আয় শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। বাব-মাকে আর্থিক সহায়তা করার অভিপ্রায়ে এ সময় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া বালক যতীন সরকার স্থানীয় বাজারে চাটাই বিছিয়ে ভাসমান মুদি দোকান খুলে পান, বিড়ি, বিস্কুট, চাল, ডাল, তেল নুন ইত্যাদি বিক্রি করেন।
দোকানদারি করার পাশাপাশি তিনি পড়াশোনাও চালিয়ে যান। ১৯৫৪ সালে তিনি মেট্রিক পাস করেন। এ সময় আইএ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার মতো টাকাপয়সা তার এবং তার পরিবারের হাতে ছিল না। তাই হাটের দিন স্থানীয় বাজারে দোকানদারি করার পাশাপাশি তিনি টিউশনি করে টাকা জমিয়ে নেত্রকোনা কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। অর্থাভাবে তিনি নেত্রকোনা শহরে লজিং থাকেন। এ সময় তিনি ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নেত্রকোনা কলেজের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। পুনরায় টিউশনি করে টাকা জমিয়ে তিনি ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ময়মনসিংহ শহরেও তিনি লজিং থেকে পড়াশোনা করেন। সাংসারিক টানাপোড়নের কারণে বিএ পরীক্ষা দিয়েই তিনি জীবিকার তাগিদে নেত্রকোনার আশুজিয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। পরে তিনি বারহাট্টা সিকেপি পাইলট হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। এখানে ছাত্র হিসেবে তিনি কবি নির্মলেন্দু গুণকে পান। শিক্ষকতা ও টিউশনি করে টাকা জমিয়ে তিনি ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। এখানে শিক্ষক হিসেবে তিনি জাতীয় অধ্যাপক মুস্তফা নুরু উল ইসলাম ও ড. এনামুল হককে পান। তার মানস গঠনে এ দুজন শিক্ষক বিরাট ভূমিকা পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে তিনি এমএ পাস করেন। একই বছর তিনি ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর হাইস্কুলে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এক বছর সেখানে শিক্ষকতার পর ১৯৬৪ সালে তিনি ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি একটানা প্রায় ৪০ বছর সেখানে অধ্যাপনা করেন। এ সময় তিনি প্রিয় বন্ধু শচীন আইসের বোন প্রিয়দর্শিনী কানন দেবী আইসকে বিয়ে করেন।
ষাটের দশকের শেষের দিকে তিনি ময়মনসিংহের সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। আনন্দমোহন কলেজে অধ্যয়নকালেই তিনি কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হন। এ সময় জোসেফ স্টালিনের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং মানবেন্দ্র নাথ রায়ের ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান নামক দুটি পুস্তক তাকে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে। শিক্ষকতা ও রাজনীতিতে পরিপক্বতা সাধনের নিমিত্তে এ পর্বে তিনি ইতিহাস, ভূগোল, ধর্ম, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনীতিবিষয়ক নানা দেশি-বিদেশি গ্রন্থ অভিনিবেশ সহযোগে পাঠ করে তার মানস গঠনকে পূর্ণতা দানের প্রায়াস পান। একটানা প্রায় ৪০ বছর নাসিরাবাদ কলেজে অধ্যাপনা শেষে ২০০২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৫ সালে তিনি ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে নিজ জেলা নেত্রকোনার সাতপাইতে বানপ্রস্থ নামক আপন গৃহে বসবাস শুরু করেন। ২০০৭ সাল থেকে তিনি ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করে আসছিলেন। গত ১৩ আগস্ট দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে তার জীবনাবসান ঘটে।
লেখালেখির পাশাপাশি যতীন সরকার ছিলেন একজন শিল্প সংগঠক। ১৯৮৭ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি উদীচীর জাতীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন জাতীয় কমিটির সভাপতি। ময়মনসিংহের নাগরিক কমিটি এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সঙ্গে তিনি গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহের মুক্ত বাতায়ন পাঠচক্রের প্রতিষ্ঠাতা। নেত্রকোনার অজপাড়া-গায়ে থেকেও তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে তিনি দাঙ্গাবিরোধী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তাকে দমানোর জন্য শ্বশুরের পরিবারের সঙ্গে তার স্ত্রীকে তখন এ-দেশীয় রাজাকাররা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। কিন্তু তিনি দমে যাননি; বরং প্রচণ্ড সাহসিকতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে আরও সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
সারা জীবন তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়েছেন। একালের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের কুসংস্কার নিয়েও লিখতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। বলেছেন, ‘আমরা শিক্ষিত মানুষজন আসলে কতগুলো দুর্মর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন’। তিনি আধুনিক যুগকে ‘যেন এক বৃন্তহীন পুষ্প’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নগরসাহিত্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের লুপ্তপ্রায় লোকসাহিত্যকে তিনি বাঙালির প্রাণের সাহিত্য হিসেবে সুধীজনের কাছে উপস্থাপন করেছেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রতি হুমড়ি খেয়ে না পড়ে এবং কোনো বিশেষ দুর্বলতা প্রদর্শন না করে তিনি বাংলা ভাষায় নিজস্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার তাগিদ দিয়েছেন। চর্যাপদ, জীবনী-সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি, কবিয়াল ও শায়ের এবং পুঁথি সাহিত্য থেকে পাঠ নিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের মৌল ভিত্তিকে শক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই লিখেছেন, ‘যতীন সরকার নানা কারণে আমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় তার নিষ্ঠা সুবিদিত। আদর্শবাদের প্রতি পক্ষপাতে তিনি দুষ্ট নন। তার সর্ববিধ বিচারে জীবনের প্রতি গভীর আসক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তত্ত্বের সঙ্গে জীবনানন্দের এ যোগ তার কাছ থেকে আমাদের বড় পাওয়া’।
মূলত তার অপূর্ব ব্যক্তিত্ব ও সরল সাধারণ এবং অনাড়ম্বর জীবনদর্শন তাকে ডান, বাম, মধ্য তথা সব মহলে গ্রহণযোগ্য ও বরণীয় করে তুলেছে। দীর্ঘ ছয় দশকের সারস্বত সাধনার মধ্যদিয়ে তিনি শ্রেণি শিক্ষক থেকে জাতির শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তার রচনা, সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা এবং চলন-বলন-কথন আসলে তার ছাত্রছাত্রীনন্দিত অনন্য শিক্ষকতারই শিল্পরূপ। এভাবে প্রায় ছয় দশক ধরে তার বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা, লেখায় ও বক্তৃতায় মোহবিষ্ট করার নিপুণতার জন্য তিনি এ জনপদের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এক অবিস্মরণীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। মূলত বাংলা মূলকের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও খাঁটি দেশপ্রেমিক এবং শিল্পপ্রেমী সমাজচিন্তকের কাছে তিনি চিরকাল আলোরদিশারী এবং পথিককৃৎ হয়ে বেঁচে থাকবেন।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং সাবেক পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর