রাশিয়ার এই কর্মকাণ্ড হঠাৎ শুরু হয়নি। বরং এটি ‘প্রজেক্ট নিভেলির’ নামের একটি বহু বছরের গোপন সামরিক প্রকল্পের অংশ, যা শুরু হয় ২০১১ সালে। ডাচ গবেষক ও স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং বিশেষজ্ঞ মার্কো ল্যাংব্রুক এবং রুশ মহাকাশ বিশ্লেষক বার্ট হেনড্রিক্স জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের অধীনে রাশিয়া ইতোমধ্যেই অন্তত তিনবার এই ধরনের স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে, যেগুলো পরে ছোট অস্ত্রবাহী বস্তু নির্গত করেছে।
এই সাবস্যাটেলাইটগুলো অনেক সময় রাশিয়ার নিজস্ব স্যাটেলাইটেই হামলার মহড়া চালায়, যেন আন্তর্জাতিক তদন্ত এড়ানো যায়। কখনো এগুলো দ্রুত কক্ষপথ বদলে বা প্রজেক্টাইল নিক্ষেপ করে যুদ্ধের অনুশীলন চালায়।
রাশিয়া কি মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করছে?
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে এক সাক্ষাৎকারে ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন—মস্কো সম্ভবত মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে। এমন ঘটনা ঘটলে তা হবে আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি।
তিনি বলেন, ‘যদি কোনোদিন স্যাটেলাইটের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা গোটা বিশ্বের যোগাযোগ, ন্যাভিগেশন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে।’
অতীতের ছায়া কসমস স্যাটেলাইটের রহস্যময় ইতিহাস
২০১৩ ও ২০১৫ সালে ‘কসমস-২৪৯১’ ও ‘কসমস-২৪৯৯’ নামের দুটি রুশ স্যাটেলাইট রহস্যজনকভাবে ভেঙে পড়ে। সম্ভবত মহাকাশে অস্ত্র পরীক্ষার ফলেই এগুলো ধ্বংস হয়েছিল।
২০১৭ সালে ‘কসমস-২৫১৯’ স্যাটেলাইট থেকে ‘কসমস-২৫২১’ নামের আরেকটি স্যাটেলাইট অবমুক্ত হয়, এবং এর মধ্য থেকেও ‘কসমস-২৫২৩’ নামের তৃতীয় আরেকটি স্যাটেলাইট বের হয়ে আসে। তৃতীয় এই স্যাটেলাইটটি আচমকা কক্ষপথ বদলে বিস্ময় সৃষ্টি করে।
২০২০ সালে কসমস-২৫৪৩ একটি গোপন প্রজেক্টাইল ছুড়ে দেয় কসমস-২৫৩৫-এর দিকে, যেটি ছিল নিবন্ধনহীন এবং আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন।
নিভিলার (Nivelir) প্রকল্প পরিচালনার মূল দায়িত্বে রয়েছে মস্কো ভিত্তিক TsNIIKhM (Central Scientific Research Institute of Chemistry and Mechanics)। এটি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি করে।
প্ল্যাটফর্ম ও স্যাটেলাইট বানানোর দায়িত্বে রয়েছে NPO Lavochkin, আর TsNIIKhM তৈরি করছে ক্ষেপণাস্ত্রধর্মী গোপন পে-লোড ও পরীক্ষামূলক অস্ত্র।
বিশ্ব কি একটি নীরব মহাকাশ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে?
ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন মতে, রাশিয়ার এই ‘মাতৃস্যাটেলাইট’ কৌশল শুধুই নজরদারি নয়, বরং মহাকাশকে পরিণত করছে সম্ভাব্য যুদ্ধক্ষেত্রে। যেখানে লড়াই হবে না কোনো গোলাগুলিতে, বরং হবে নিঃশব্দে—কক্ষপথ বদলের মধ্য দিয়ে, কিংবা এক মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া কোনো উপগ্রহের মাধ্যমে।
বিশ্ব যত বেশি স্যাটেলাইট-নির্ভর হয়ে পড়ছে, ততই এই ছায়াযুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আর রাশিয়ার ‘নিভেলির’ প্রকল্প সেই যুদ্ধকে আরেক ধাপে এগিয়ে নিচ্ছে—নির্বাক, অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত ভয়ানক।